সুলতানি আমলে বাংলা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এই সময়ে বহু মুসলিম শাসক বাংলা শাসন করেন, যারা বাংলাকে একটি স্বাধীন ও সমৃদ্ধ রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলেন। এই সুলতানদের শাসনামলে বাংলায় স্থাপত্য, সাহিত্য, এবং শিল্পকলার ব্যাপক উন্নতি ঘটে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন মহান যোদ্ধা, আবার কেউ কেউ ছিলেন ন্যায়পরায়ণ শাসক। এই সুলতানদের তালিকা বাংলার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা এই অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনকে বুঝতে সাহায্য করে। এই সুলতানদের অবদান বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
১) শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৫২-১৩৫৮)
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ছিলেন বাংলা সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা এবং ইলিয়াস শাহী রাজবংশের প্রথম সুলতান। তিনি ১৩৫২ সালে দিল্লির সুলতানি শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল একত্রিত করেন এবং সোনারগাঁও ও সাতগাঁও জয় করে স্বাধীন বাংলা সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনের মাধ্যমে বাংলায় রাজনৈতিক ঐক্য ও স্থিতিশীলতা আসে। ইলিয়াস শাহ বাংলার সীমানা বিহার, নেপাল এবং উড়িষ্যা পর্যন্ত বিস্তার করেছিলেন। তিনি শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তার আমলে বাংলায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল। তার শাসনামলকে বাংলার ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হিসেবে ধরা হয়।
২) আবুল মুজাহিদ সিকান্দার শাহ (১৩৫৮-১৩৯০)
সিকান্দার শাহ ছিলেন শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পুত্র। তিনি পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন এবং প্রায় ৩২ বছর শাসন করেন। তার দীর্ঘ শাসনামল ছিল শান্তি ও সমৃদ্ধির সময়। সিকান্দার শাহ তার রাজধানী পান্ডুয়ায় বিখ্যাত আদিনা মসজিদ নির্মাণ করেন, যা বাংলার অন্যতম বৃহত্তম ও স্থাপত্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি নিদর্শন। তার আমলে দিল্লির সুলতান ফিরুজ শাহ তুঘলক বাংলা আক্রমণ করলেও তিনি সফলভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন। সিকান্দার শাহ শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার শাসনামলে বাংলার স্থাপত্যশৈলী নতুন মাত্রা লাভ করে।
৩) গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৯০-১৪১১)
গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ ছিলেন সিকান্দার শাহের পুত্র। তিনি পিতার সাথে এক দীর্ঘ সংগ্রামের পর সিংহাসনে বসেন। তার শাসনামল ছিল জ্ঞান, সংস্কৃতি এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিজের সাথে পত্রালাপ করতেন, যা তার সাহিত্য ও শিল্প অনুরাগের প্রমাণ। তার আমলে চীন, মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য অঞ্চলের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ ন্যায়বিচারের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। তার বিচারব্যবস্থা এতটাই স্বচ্ছ ছিল যে, তিনি একজন সাধারণ মানুষের কাছেও ন্যায়বিচারের জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করতে পিছপা হননি।
৪) সাইফুদ্দিন হামজা শাহ (১৪১০-১৪১৩)
সাইফুদ্দিন হামজা শাহ ছিলেন গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের পুত্র। তিনি তার পিতার মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসনে বসেন। তার রাজত্বকাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। তার শাসনকালে বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হয়ে পড়ে। তার বিরুদ্ধে জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শাহের নেতৃত্বে দিল্লির বাহিনী আক্রমণ করে, যা তিনি প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার শাসনামলে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ বৃদ্ধি পায় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি নিজ কর্মচারীদের হাতে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর বাংলা সালতানাতে এক সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়।
৫) শিহাবউদ্দিন বায়েজিদ শাহ (১৪১৩-১৪১৪)
শিহাবউদ্দিন বায়েজিদ শাহ ছিলেন রাজা গণেশের সমর্থনপুষ্ট একজন শাসক। রাজা গণেশ বাংলার একজন প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন এবং তিনিই বায়েজিদ শাহকে সিংহাসনে বসান। বায়েজিদ শাহের রাজত্বকাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত, মাত্র এক বছর। এই সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল এবং রাজা গণেশের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। যদিও তিনি সুলতান হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন, তার ক্ষমতা ছিল সীমিত। বাংলার প্রকৃত ক্ষমতা তখন রাজা গণেশের হাতে ছিল। তার শাসনামলের পর রাজা গণেশ নিজেই ক্ষমতা দখল করেন এবং বাংলার সিংহাসনে বসেন।
৬) আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৪১৪)
আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ ছিলেন শিহাবউদ্দিন বায়েজিদ শাহের পুত্র। তিনি পিতার মৃত্যুর পর অল্প সময়ের জন্য বাংলার সিংহাসনে বসেন। তার রাজত্বকাল এতটাই সংক্ষিপ্ত ছিল যে, ইতিহাসবিদদের কাছে তার সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য নেই। তার ক্ষমতার সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল চরমে এবং শেষ পর্যন্ত তিনি রাজা গণেশের হাতে নিহত হন। আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর রাজা গণেশ সরাসরি বাংলার ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং হিন্দু রাজবংশের সূচনা করেন।
৭) জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ (১৪১৫-১৪১৬ এবং ১৪১৮-১৪৩৩)
জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ ছিলেন রাজা গণেশের পুত্র। তিনি প্রথমে পিতার নির্দেশে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে আবার ইসলাম ধর্মে ফিরে আসেন। তিনি দুই দফায় বাংলার সুলতান হিসেবে শাসন করেন। তার প্রথম রাজত্বকাল ছিল সংক্ষিপ্ত এবং দ্বিতীয় রাজত্বকাল ছিল দীর্ঘ। তিনি বাংলার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনেন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তার আমলে বাংলার শিল্পকলা, স্থাপত্য এবং সাহিত্য চরম উৎকর্ষ লাভ করে। তিনি গৌড়ে অনেক নতুন মসজিদ, মাদ্রাসা এবং অন্যান্য স্থাপত্য নির্মাণ করেন। তার শাসনামলে চীন, মিশর এবং অন্যান্য দেশের সাথে বাংলার বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হয়।
৮) শামসুদ্দিন আহমেদ শাহ (১৪৩৩-১৪৩৫)
শামসুদ্দিন আহমেদ শাহ ছিলেন জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহের পুত্র। তিনি পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন। তার রাজত্বকাল ছিল সংক্ষিপ্ত, মাত্র দুই বছর। এই সময়ে বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবার অস্থির হয়ে ওঠে। তিনি ছিলেন একজন দুর্বল শাসক এবং তার বিরুদ্ধে প্রভাবশালী উজির শাদি খান এবং অন্যান্য অভিজাতরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। শেষ পর্যন্ত শামসুদ্দিন আহমেদ শাহকে তার নিজস্ব কর্মচারীরা হত্যা করে। তার মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসন ইলিয়াস শাহী রাজবংশের হাতে ফিরে আসে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দীর্ঘ সময়ের জন্য ফিরে আসে।
৯) নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৩৫-১৪৫৯)
নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ ছিলেন ইলিয়াস শাহী রাজবংশের একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাসক। তিনি প্রায় ২৪ বছর ধরে বাংলা শাসন করেন। তার শাসনামলে বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত স্থিতিশীল ছিল এবং তিনি অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করেছিলেন। তার আমলে গৌড় নগরীর উন্নয়ন হয় এবং অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা এবং অন্যান্য স্থাপত্য নির্মিত হয়। তিনি একজন যোগ্য শাসক ও প্রশাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার আমলে বাংলার সীমান্ত আরো প্রসারিত হয় এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নত হয়।
১০) রুকনুদ্দিন বরবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪)
রুকনুদ্দিন বরবক শাহ ছিলেন নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের পুত্র। তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী ও দক্ষ শাসক। তার আমলে বাংলার ক্ষমতা আরো সুসংহত হয় এবং সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। তিনি আফ্রিকান বংশোদ্ভূত সৈন্যদের নিয়ে একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন করেন, যা পরবর্তীকালে বাংলার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি শিল্প, সাহিত্য এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার রাজত্বকালে অনেক পন্ডিত এবং জ্ঞানী ব্যক্তি তার দরবারে আশ্রয় পেয়েছিলেন। তার শাসনামলে গৌড় নগরীর স্থাপত্য আরো সমৃদ্ধ হয়।
১১) শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-১৪৮১)
শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ ছিলেন রুকনুদ্দিন বরবক শাহের পুত্র। তিনি একজন ধর্মপ্রাণ এবং ধার্মিক শাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার আমলে ধর্মীয় বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া হয় এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি স্থাপত্য শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তার আমলে গৌড়ে অনেক নতুন মসজিদ ও ইমারত নির্মিত হয়। তার শাসনামলে বাংলার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় ছিল এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে। তিনি কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতেন এবং কোনো অপরাধীকেই ক্ষমা করতেন না।
১২) নূরউদ্দিন সিকান্দার শাহ (১৪৮১)
নূরউদ্দিন সিকান্দার শাহ ছিলেন শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহের পুত্র। তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বাংলার সিংহাসনে বসেন। তার রাজত্বকাল ছিল মাত্র কয়েক মাস। এই সময়ে রাজপরিবারের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং তিনি শীঘ্রই তার চাচা জালালুদ্দিন ফতেহ শাহের হাতে নিহত হন। তার সংক্ষিপ্ত শাসনের সময়কাল ছিল অস্থিরতাপূর্ণ এবং এতে বাংলার রাজনৈতিক দুর্বলতা প্রকাশিত হয়।
১৩) জালালুদ্দিন ফতেহ শাহ (১৪৮১-১৪৮৭)
জালালুদ্দিন ফতেহ শাহ ছিলেন ইলিয়াস শাহী রাজবংশের শেষ প্রভাবশালী শাসক। তিনি তার ভাইপোকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। তিনি একজন কঠোর এবং ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি সামরিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন এবং রাজতন্ত্রের ক্ষমতাকে সুসংহত করার চেষ্টা করেন। তবে তার কঠোর নীতি অভিজাত এবং হাবশি (আফ্রিকান বংশোদ্ভূত) সেনাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। অবশেষে, তার বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থান হয় এবং হাবশি সেনারা তাকে হত্যা করে। তার মৃত্যুর পর ইলিয়াস শাহী রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে এবং হাবশিদের ক্ষমতা শুরু হয়।
১৪) গিয়াসউদ্দিন বরবক শাহ (১৪৮৭)
গিয়াসউদ্দিন বরবক শাহ ছিলেন হাবশি শাসক শাহজাদা বরবক। তিনি জালালুদ্দিন ফতেহ শাহকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন। তার রাজত্বকাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত, মাত্র কয়েক মাস। তার শাসনামল ছিল অস্থিরতাপূর্ণ এবং তিনি অভিজাতদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন না। তার শাসনের বিরুদ্ধে দ্রুতই আরেকটি ষড়যন্ত্র হয় এবং তাকে হত্যা করা হয়। তার মৃত্যুর পর বাংলায় হাবশি রাজবংশের শাসন শুরু হয়, যা অল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয়েছিল।
১৫) সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৪৮৭-১৪৮৯)
সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহ ছিলেন একজন হাবশি শাসক। তিনি গিয়াসউদ্দিন বরবক শাহকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনি একজন যোগ্য এবং ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। তার সংক্ষিপ্ত শাসনামলে তিনি কিছু জনহিতকর কাজ করেছিলেন। তিনি গৌড়ে একটি মসজিদ এবং অন্যান্য ইমারত নির্মাণ করেন। তবে তার শাসনকাল ছিল মাত্র দুই বছর এবং তিনি হাবশি অভিজাতদের মধ্যেই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। অবশেষে তিনি তাদের হাতেই নিহত হন। তার মৃত্যুর পর হাবশি শাসকদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই আরও তীব্র হয়।
১৬) নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ (১৪৮৯-১৪৯০)
নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ ছিলেন হাবশি বংশের একজন সুলতান। তিনি সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন। তার রাজত্বকাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। তিনি অভিজাতদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং তার শাসনের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তার বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থান হয় এবং তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। তার শাসনের পর বাংলায় রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছায়।
১৭) শামসুদ্দিন মোজাফফর শাহ (১৪৯০-১৪৯৪)
শামসুদ্দিন মোজাফফর শাহ ছিলেন একজন হাবশি শাসক। তিনি নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসন দখল করেন। তিনি ছিলেন একজন অত্যাচারী শাসক এবং তার আমলে সামরিক বাহিনী এবং অভিজাতদের মধ্যে অসন্তোষ চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। তার অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার অভিজাত ও সাধারণ মানুষ বিদ্রোহ করে। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন তার উজির আলাউদ্দিন হুসেন শাহ। এক দীর্ঘ অবরোধের পর তিনি পরাজিত ও নিহত হন। তার মৃত্যুর পর হাবশি রাজবংশের শাসনের অবসান হয়।
১৮) আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৪-১৫১৯)
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ছিলেন হুসেন শাহী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান। তিনি একজন উজির ছিলেন এবং সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। তার শাসনামলে বাংলায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ফিরে আসে। তিনি হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখেছিলেন। তার আমলে শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য এবং সংস্কৃতির চরম বিকাশ ঘটে। তার দরবারে অনেক বিখ্যাত পন্ডিত, কবি এবং শিল্পী আশ্রয় পেয়েছিলেন। তার শাসনামলকে বাংলার ইতিহাসে 'স্বর্ণযুগ' হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৯) নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ (১৫১৯-১৫৩৩)
নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ ছিলেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহের পুত্র। তিনি পিতার মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনি একজন যোগ্য ও দক্ষ শাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার শাসনামলে মুঘল সম্রাট বাবরের বাংলা আক্রমণের বিরুদ্ধে তিনি সফলভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তার আমলে গৌড়ে বিখ্যাত কদম রসুল মসজিদ নির্মিত হয়। তার শাসনামলে বাংলার স্থাপত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ অব্যাহত ছিল। তার মৃত্যুর পর বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবার অস্থির হয়ে ওঠে।
২০) দ্বিতীয় আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৫৩৩)
দ্বিতীয় আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ ছিলেন নাসিরুদ্দিন নসরত শাহের পুত্র। তিনি পিতার মৃত্যুর পর অল্প সময়ের জন্য বাংলার সিংহাসনে বসেন। তার রাজত্বকাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত এবং তিনি তার চাচা গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের হাতে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর হুসেন শাহী রাজবংশের পতন শুরু হয়।
২১) গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৫৩৩-১৫৩৮/৩৯)
গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ ছিলেন হুসেন শাহী রাজবংশের শেষ সুলতান। তিনি তার ভাইপোকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন। তার শাসনামল ছিল অস্থিরতাপূর্ণ এবং তিনি শের শাহ সুরির আক্রমণের শিকার হন। শের শাহের কাছে পরাজিত হয়ে তিনি বাংলায় তার রাজত্ব হারান। তার পরাজয়ের পর বাংলায় আফগান শাসন শুরু হয় এবং মুঘলদের ক্ষমতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
২২) শামসুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ (১৫৫৩-১৫৫৫)
শামসুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ ছিলেন মুহাম্মদ শাহ সুরির একজন সেনাপতি। তিনি শের শাহ সুরির মৃত্যুর পর বাংলার ক্ষমতা দখল করেন। তার রাজত্বকাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত এবং তিনি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের কারণে ক্ষমতা হারান। তার মৃত্যুর পর বাংলায় রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছায়।
২৩) গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ (১৫৫৫-১৫৬১ এবং ১৫৬৩-১৫৬৪)
গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ ছিলেন শের শাহ সুরির একজন সেনাপতি। তিনি বাংলায় ক্ষমতা দখল করেন এবং আফগান রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী ও দক্ষ শাসক। তার আমলে বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হয়। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র গিয়াসউদ্দিন জালাল শাহ সিংহাসনে বসেন।
২৪) গিয়াসউদ্দিন জালাল শাহ (১৫৬১-১৫৬৩)
গিয়াসউদ্দিন জালাল শাহ ছিলেন গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহের পুত্র। তিনি পিতার মৃত্যুর পর সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বাংলার সিংহাসনে বসেন। তার রাজত্বকাল ছিল অস্থিরতাপূর্ণ এবং তিনি তার চাচা তাজ খান কাররাণীর হাতে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর কাররাণী রাজবংশের সূচনা হয়।
২৫) দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ (১৫৬৩-১৫৬৪)
দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ ছিলেন গিয়াসউদ্দিন জালাল শাহের পুত্র। তিনি পিতার মৃত্যুর পর সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বাংলার সিংহাসনে বসেন। তার রাজত্বকাল ছিল মাত্র এক বছর এবং তিনি তাজ খান কাররাণীর হাতে পরাজিত হন। তার মৃত্যুর পর বাংলায় কাররাণী রাজবংশের শাসন শুরু হয়।
২৬) তাজ খান কাররাণী (১৫৬৪-১৫৬৬)
তাজ খান কাররাণী ছিলেন শের শাহ সুরির একজন সেনাপতি এবং কাররাণী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আফগান বংশোদ্ভূত ছিলেন এবং বাংলার ক্ষমতা দখল করেন। তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী এবং দক্ষ শাসক। তার শাসনামলে বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হয় এবং তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
২৭) সুলায়মান খান কাররাণী (১৫৬৬-১৫৭২)
সুলায়মান খান কাররাণী ছিলেন তাজ খান কাররাণীর ভাই। তিনি তাজ খান কাররাণীর মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনি একজন বিচক্ষণ এবং শক্তিশালী শাসক ছিলেন। তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সাথে একটি চুক্তি করেন এবং তার আনুগত্য স্বীকার করেন। এই চুক্তির ফলে বাংলায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। তার আমলে বাংলার শিল্পকলা, সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যের বিকাশ অব্যাহত ছিল।
২৮) বায়েজিদ খান কাররাণী (১৫৭২)
বায়েজিদ খান কাররাণী ছিলেন সুলায়মান খান কাররাণীর পুত্র। তিনি পিতার মৃত্যুর পর সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বাংলার সিংহাসনে বসেন। তার রাজত্বকাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত এবং তিনি তার চাচা দাউদ খান কাররাণীর হাতে নিহত হন।
২৯) দাউদ খান কাররাণী (১৫৭২-১৫৭৬)
দাউদ খান কাররাণী ছিলেন বায়েজিদ খান কাররাণীর চাচা। তিনি বায়েজিদকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন কাররাণী রাজবংশের শেষ শাসক। তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং এর ফলে মুঘলদের সাথে তার যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। তার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলায় আফগান শাসনের অবসান হয় এবং মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার শুরু হয়।