চলে যাব তবু যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ – ভাবসম্প্রসারণ ?
Explanation
চলে যাব তবু যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ – ভাবসম্প্রসারণ “চলে যাব তবু যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ” – বাংলা সাহিত্যের এই বিখ্যাত উক্তিটি আত্মনিবেদন, জীবন দর্শন, এবং কর্মে অবিচল থাকার আহ্বানকে প্রতিফলিত করে। এটি মূলত মানব জীবনের অস্থায়ীত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়, একই সাথে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিকে প্রমাণ করার কথা বলে। আমরা সবাই জানি যে আমাদের এই জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু এই সাময়িক সময়টুকুকে অর্থপূর্ণ করে তোলা আমাদের দায়িত্ব।
প্রত্যেক মানুষের জীবন সীমাবদ্ধ। জন্মের সময় থেকেই মানুষের মৃত্যু অবধারিত; তবুও প্রতিটি মুহূর্তে মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য শক্তি রয়েছে। এখানে আলোচিত হয়েছে যে, জীবন ক্ষণস্থায়ী হলেও যতক্ষণ প্রাণ আছে, ততক্ষণ জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো উচিত। এই ভাবনার মূল ধারণা আমাদের শেখায় যে জীবন যতদিন আছে, আমরা যেনো তা সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাই এবং আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণ করে তুলি।
চলে যাব তবু যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
এই প্রসারিত আলোচনাগুলির মধ্যে দিয়ে আমরা দেখতে পাই, “চলে যাব তবু যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ” উক্তিটি আমাদের জীবনের প্রতি দায়িত্বশীলতা, মানবতার প্রতি ভালোবাসা এবং নিজের আত্মার উন্নতির জন্য অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। এই উক্তি শুধু আত্মশক্তি এবং সাহসের অনুপ্রেরণা দেয় না; এটি আমাদের শেখায় কীভাবে আত্ম-অনুসন্ধান, অধ্যবসায় এবং মানবতার সেবায় নিজেদের নিঃস্বার্থভাবে নিবেদিত করা যায়। মৃত্যুর চিন্তা আমাদেরকে দুর্বল করে না বরং জীবনকে আরও সম্পূর্ণভাবে উদযাপন করার সুযোগ দেয়।
প্রথম পর্যায়: জীবনের অস্থায়ীত্ব এবং তা সত্ত্বেও কর্মশীলতা
জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং আমাদের সময় সীমিত। আমরা জন্মের পর থেকে বৃদ্ধির পথে চলতে থাকি এবং মৃত্যুর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের জীবন এবং সমাজের প্রতি একটি দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাই জীবন যতক্ষণ আছে, আমাদের উচিত নিজের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে কাজ করে যাওয়া। এই কাজের মাধ্যমেই আমরা নিজেদের প্রকৃত মূল্য দিতে পারি। জীবনের অস্থায়ীত্বকে অতিক্রম করার একমাত্র পথই হলো সাধনা ও কর্ম।
দ্বিতীয় পর্যায়: আত্মনিবেদন ও উদ্দীপনার প্রয়োজনীয়তা
এই উক্তির মাধ্যমে মানুষকে তার কর্মে অবিচল থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। আমাদের জীবনে নানা প্রতিবন্ধকতা, সমস্যা ও অসুবিধা আসে, কিন্তু যতক্ষণ প্রাণ আছে, ততক্ষণ কর্মে নিয়োজিত থাকার মাধ্যমেই আমরা এসব সমস্যার সমাধান করতে পারি। জীবনে ব্যর্থতা বা হতাশা থাকলেও এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সাহস, উদ্দীপনা এবং আত্মনিবেদন। একজন ব্যক্তি যখন জীবনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন এবং সাধনার প্রতি সমর্পিত থাকেন, তখন তার পথের সব বাঁধা দূর হয়ে যায়।
তৃতীয় পর্যায়: সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং জীবনকে অর্থবহ করার দীক্ষা
মানব জীবনের অন্যতম গৌরব হলো তার সমাজে দায়িত্ব পালন করা। আমরা যেনো অন্যদের জন্যও কিছু করে যেতে পারি। যতক্ষণ প্রাণ আছে, ততক্ষণ আমাদের উচিত সমাজের কল্যাণে, মানুষের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখা। যারা সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করেন, তাদের জীবনই প্রকৃত অর্থে সফল। আমাদের ব্যক্তিগত লক্ষ্য ছাড়াও সমাজে যেসব সমস্যা বিদ্যমান, সেগুলোর সমাধানে কাজ করা আমাদের মানবিক কর্তব্য। এটি কেবল আমাদের আত্মাকে তৃপ্ত করে না, বরং সমাজকেও উন্নতির পথে নিয়ে যায়।
চতুর্থ পর্যায়: ধৈর্য ও সংকল্পের শক্তি
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের ধৈর্য এবং সংকল্প থাকা অত্যন্ত জরুরি। আমরা জানি না কখন কোন সমস্যার সম্মুখীন হব, কিন্তু আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এই সমস্যাগুলোর মুখোমুখি দাঁড়ানো এবং শেষ পর্যন্ত নিজের শক্তিতে এগিয়ে যাওয়া।

এই সংকল্পশক্তিই আমাদের জীবনের প্রতিটি সংগ্রামে টিকে থাকতে সহায়তা করে। “চলে যাব তবু যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ” এই উক্তিটি আমাদের শেখায় যে, আমরা যেনো কখনো হাল না ছেড়ে দিই।
পঞ্চম পর্যায়: মানুষের মাঝে সৃষ্টির আনন্দ এবং কৃতিত্ব অর্জনের প্রেরণা
জীবনের শেষ পর্যন্ত যদি আমরা কেবল প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্যবান মনে করে কাজ করে যাই, তবে এর মাধ্যমে আমরা শুধুমাত্র নিজের জীবনকে নয়, অন্যদের জীবনকেও সমৃদ্ধ করতে পারি। এমন কাজের মাধ্যমে আমাদের জীবন সুখময় হয় এবং মৃত্যুর পরেও মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকে। মানুষের মাঝে সৃষ্টির আনন্দ এবং কৃতিত্ব অর্জনের প্রেরণাই এই ভাবসম্প্রসারণের মূল কথা।
ষষ্ঠ পর্যায়: আধ্যাত্মিক চিন্তা ও মৃত্যু সম্পর্কে উপলব্ধি
জীবনের শেষ পর্যন্ত মানুষের মনে আধ্যাত্মিক চিন্তার গভীরতা দেখা যায়। মানুষ জানে যে, পৃথিবীতে কেউ চিরকাল থাকেনা। মৃত্যুর পর আমাদের যে শূন্যতায় যেতে হবে, তার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া আমাদের কর্তব্য। আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টিতে এই ক্ষণস্থায়ী জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্য যেসব ভালো কাজ আমাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে, সেগুলোতেই আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ থাকা উচিত। মৃত্যুকে সম্মান জানানো এবং তা মেনে নেওয়া, আমাদের জীবনকে সফল এবং পরিপূর্ণ করতে সহায়তা করে।
সপ্তম পর্যায়: মানবতার সেবা ও সহানুভূতির প্রসার
“চলে যাব তবু যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ” উক্তিটি আমাদেরকে শুধু নিজেদের নয়, মানবতার কল্যাণে নিবেদিত হওয়ার প্রেরণা দেয়। মানুষ হিসেবে আমাদের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত মানবতার সেবা করা। যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে, ততক্ষণ আমাদের উচিত অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, তাদের সমস্যায় সাহায্য করা এবং তাদের জীবনের মান উন্নয়নে সহযোগিতা করা। মানবতার সেবায় আত্মনিবেদন করলে জীবন আরও অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই মানসিকতা ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতার বন্ধনকে মজবুত করে।
অষ্টম পর্যায়: ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও আত্ম-আবিষ্কার
এই উক্তি আমাদের ব্যক্তিগত উন্নয়ন এবং আত্ম-আবিষ্কারের জন্যও উৎসাহ দেয়। মানব জীবনের শেষ অবধি ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য চেষ্টা করে যাওয়া উচিত। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সৃষ্টিশীল কাজে ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আমাদের সেরা সংস্করণে রূপান্তরিত হতে পারি। আমাদের কাজের মাধ্যমে আমাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোই প্রকৃত উন্নতি। যখন আমরা নিজেদেরকে বারবার নতুন করে আবিষ্কার করতে পারি, তখন আমরা জীবনকে আরও ভালোভাবে বুঝতে এবং গ্রহণ করতে পারি।
নবম পর্যায়: সাহসিকতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মনোভাব
এই উক্তি আমাদেরকে জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে সাহসিকতার সাথে গ্রহণ করার আহ্বান জানায়। জীবনের প্রতিটি দিন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে, এবং আমাদের দায়িত্ব হলো সেই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা। সাহসিকতা হলো সেই শক্তি, যা আমাদেরকে কঠিন সময়েও নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হতে দেয় না। কঠিন সময়গুলোতে যদি আমরা নিজেকে শক্তিশালীভাবে ধরে রাখতে পারি এবং সমস্যার সমাধানে মনোযোগী হই, তবে জীবনে সাফল্যের পথ আরও সুগম হয়।
দশম পর্যায়: অধ্যবসায় এবং মানসিক দৃঢ়তা
অধ্যবসায় এবং মানসিক দৃঢ়তা জীবনের একান্ত প্রয়োজনীয় দুটি গুণ। “চলে যাব তবু যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ” আমাদের শিখায় যে, জীবনে ধৈর্য ধরে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবনে বিভিন্ন বাধা ও প্রতিবন্ধকতা আসবে, কিন্তু অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সেই বাধাগুলো অতিক্রম করা সম্ভব। মানসিক দৃঢ়তা আমাদের চেতনার গভীরে থাকা শক্তি, যা কঠিন সময়ে আমাদের এগিয়ে যেতে সাহস দেয়। জীবনের শেষ পর্যন্ত অধ্যবসায় ধরে রাখা, সংকল্পবদ্ধ থাকা এবং মনের শক্তি বজায় রাখা আমাদের সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি।
একাদশ পর্যায়: জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গমে নিজের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করা
এই ভাবনা আমাদের জীবনের প্রকৃত অর্থ এবং প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত গভীরতা উপলব্ধি করার পথ দেখায়। আমরা কেবল একটি সময়ের জন্য পৃথিবীতে এসে প্রকৃতির অংশ হিসেবে থেকে যাই। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ ও স্পন্দন উপলব্ধি করার মধ্য দিয়ে আমরা জীবনের সৌন্দর্য এবং প্রকৃতির শক্তিকে সম্মান জানাই। আমাদের সময় সীমিত হলেও প্রকৃতির অংশ হিসেবে জীবনকে গড়ে তোলার এবং এটি থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এই উপলব্ধি আমাদের জীবনের প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং শান্তি এনে দেয়।
দ্বাদশ পর্যায়: আত্ম-সমর্পণ এবং নির্ভীক মনোভাব
“চলে যাব তবু যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ” আমাদেরকে আত্মসমর্পণ ও নির্ভীক মনোভাব গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। জীবনের শেষ পর্যন্ত আমাদের উচিত সব পরিস্থিতিতে স্থির ও শান্ত থেকে নিজের কাজ করে যাওয়া। এতে আমরা সাফল্য হোক বা ব্যর্থতা – যে কোনো ফলাফলের জন্য প্রস্তুত থাকি। আত্মসমর্পণের অর্থ হলো নিজের ভাগ্যকে মেনে নেওয়া এবং যা কিছু ঘটে তার প্রতি সমানভাবে গ্রহণযোগ্য থাকা। এই নির্ভীক মনোভাব আমাদের জীবনের প্রতি ভয় দূর করে এবং আমাদেরকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
উপসংহার
“চলে যাব তবু যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ” উক্তিটি আমাদের জীবনের অস্থায়ীত্বের শিক্ষা দেয়, কিন্তু পাশাপাশি এটি আমাদের উজ্জীবিত করে এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অর্থবহ করতে উৎসাহিত করে। জীবন যতই কঠিন হোক না কেন, আমাদের দায়িত্ব হলো অটল থেকে কাজ করে যাওয়া। মৃত্যুকে ভয় না করে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানোই আমাদের উচিত।
Related Questions
ভাবসম্প্রসারণ অন্যায় যে করে
ভাবসম্প্রসারণ পরের অভাব মনে করিলে চিন্তন, আপন অভাব ক্ষোভ থাকে কতক্ষণ?
সবুরে মেওয়া ফলে ভাবসম্প্রসারণ
ভাবসম্প্রসারণ শুধু রক্তের সম্বন্ধে আত্মীয়তা হয় না, আত্মায় আত্মায় মিলনেই সৃষ্টি হ...
দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ এটি কোন দেশের প্রবাদ
ভাবসম্প্রসারণ বন্ধু, অর্থ দুই মোর সংসারেতে ছিল; দিনু ঋণ সেই অর্থ বন্ধু তা চাহিল।...
মানুষের খারাপ সময় সারাজীবন থাকে না
খারাপ সময় কাটানোর উপায়
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড ভাব সম্প্রসারণ
ভাবসম্প্রসারণ অতি বাড় বেড়ো না, ঝরে পড়ে যাবে,অতি ছোট থেকো না, ছাগলে মুড়ে খাবে।